অচেনা যাত্রী/উৎসব সংখ্যা/পৃঃ৪[শেষ]


                                বিশেষ রচনাঃ       
                                                                সুবীর সরকার
                                                     স্বপ্নপুরাণ ও আরশী নগর
     
                     লোকসংস্কৃতি লোকজীবনের আয়না আমাদের শিকড় কিন্তু বিশ্বায়ন, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসনেআজ লোকজ সংস্কৃতি ব্রাত্য ও বিপন্ন প্রতিদিন লুপ্ত হচ্ছেঅজস্র লোকভাষা, লোকজ সংস্কৃতি ,যা বিশ্ব সংস্কৃতিকেই প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ! তবে আশার কথা প্রান্তে প্রান্তে কেউ কেউ নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন লোকসংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রসারের লক্ষ্যে  । বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট শহরে লোকশিল্পী বাদশা আলম-এর উদ্যোগ ২০০৫-এ গড়ে উঠেছে আরশী নগর নামে একটি সংস্থা বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের লোকসংগীত শিল্পীদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা,লুপ্তপ্রায় লোকসংগীতের সংরক্ষণ,প্রচার প্রসার ঘটানো,প্রবীণদের কাছ থেকে লুপ্তপ্রায় লোকসংগীত নবীনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া,লোকগান ও লোকবাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ,পাশাপাশি দুঃস্থ ও অসহায় লোকশিল্পী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা,স্বাস্থ,খাদ্য,বাসস্থান নিশ্চিত করা ,অচিন পাখি নামে অনাথ শিশুশিল্পীদের আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা পাশাপাশি বাল্যবিবাহ,যৌতুকরোধ,শিশুশ্রম বন্ধ,নারীর ক্ষমতায়ন,পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বনায়ন করা,কৃষি ও মৎস্যচাষ মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা । নরওয়ের  কবি, 
অনুবাদক,সমাজকর্মী, সাহিত্যিক মিস উয়েরা সেথের সহযোগিতা ও উৎসাহে বাদশা আলম "Preservation and Promotion of Folk- Music and Folk -Artists in Northern Bangladesh" নামে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বাদশা আলম নিজস্ব বাড়ি কেনেন জমি ও স্ত্রীর সহযোগিতায় সংস্থার জন্য শুরু হয় কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যে ২২ টি গুরুকুল সঙ্গীত চর্চা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে সপ্তাহে ২ দিন সেখানে গান ও লোকবাজনার তালিম দেওয়া হয় । সংগঠনের গ্রন্থাগারে ৭৫০ টি মল্যবান বই,১৭৫ টি বাদ্যযন্ত্র সংগৃহীত হয়েছে ইতিমধ্যে কয়েকটি ক্যাসেটও হয়েছে মাঠময়দান থেকে রেকর্ড করা হয়েছে ২০০০- এর মত লোকগান । নদী -ঝাড় -জঙ্গল লোকভাষা লোকায়তে তিস্তাবাংলার লালমণীহাট এর বড়োবাড়িতে বেরে ওঠা রংপুর বেতার ও টিভি-র শিল্পী বাদশা আলম ভাই বিভিন্ন রকম লোকগান সংগ্রহ ও অনুশীলন করান সওয়ারি চালের মইশাল গাড়িয়াল বাইচের গান,বিয়েরগান,চরাঞ্ছলের মানুষের দুঃখ-বেদনার বারোমাসিয়া গান,মারফতি,মুরসিদি,লোকাচারের    গান
                        বাদশা ভাই পালাগানে অংশ নেন রংপুর সাহিত্য পরিষদ-এ লোকসংস্কৃতি বিষয়ে অভিভাষণ দেন দেশ-বিদেশ থেকে আসা গবেষকদের নানাভাবে সহযোগিতা করে আরশী নগর  বাদশা আলম তাঁর দল নিয়ে ভারতের পশ্চিমবাংলায় নানান অনুষ্ঠানও পরিবেশন করেছেন,আদায় করেছেন সমাদরও নিরবে নিরলস কাজ করে চলেছে -আরশী নগর আমাদের মুগ্ধতা রইল

====================================================
      বিশেষ রচনাঃ                     অমিত কুমার  বিশ্বাস                
                                   ওয়াল্ট  হুইটম্যান আমার উপশম
                        
           সেদ্ধভাত ও প্রিয় নারীর হৃদয় ছানার পর যদি আমার বেঁচে থাকার স্বার্থকতা ক্রমশ মেরুদন্ডী  হয়ে উঠত, তাহলে তলিয়ে যাবার পর বারংবার অতল থেকে এভাবে জেগে

উথতাম না টুকরো টুকরো অক্সিজেনের জন্য । এই তলানির ভারে  ন্যুব্জ  হয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষুধায় চেটেপুটে নিচ্ছি কবিতার পাতা । হৃদয়ের শুষে নেওয়া আলো ও  প্রিয় নারীর আঁচড়ের মতো বিপন্নতায়   নিজেকে অক্সিজেন সমন্বিত তলানি হতে কেন যে আজ বড় ভালো লাগে ! ভালো লাগে ম্যাড়মেড়ে ব্যাকরণ  বহির্ভূত পদ্যকারদের  ঝরণা দিয়ে লেখা জীবন । আর এই গলাধঃকরণের পর চরম উন্নাসীকতায় মাড়িয়ে যাই বিষাদময় নুড়িপাথর । কবিতা-মায়ের অক্লান্ত গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা এক একটি ভোরের মতো অহংকার দিয়ে বেশ দূরে সরিয়ে রাখি অপরাহ্নের সূর্যকে । এক্ষেত্রে আমার বুভূক্ষ মন অবলীলাক্রমে খুঁজে নেয় 'রূপসী বাংলা ' অথবা দ্বীপান্তরের বনস্পতিতে ঝড়ে পড়া এই ভোরের আত্মাকে ।
          যে সভ্যতার  ডাইনোসরী মনঃস্কাম আমার বিবমিষাকে বাড়িয়ে নির্দ্বিধায় পেয়ে যাচ্ছে অম্লান ঘৃণাবোধ ,সেখানেই সে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের জন্য  ভালোবাসা পাচ্ছে ,যাঁরা প্রতিবাদী,দেশ-কাল পেরিয়ে এক-একজন বিশুদ্ধ  নাগরিক ।ওয়াল্ট  হুইটম্যান [১৮১৯-১৮৯১] এমনই একজন বিশ্বনাগরিক তথা কাব্য-সম্রাট ,যাঁর মহাপ্রয়াণের একশতাব্দী পরও বিশ্বসাহিত্যের  অসীম আকাশে একটি বিরল জ্যোতিষ্ক নিভৃতে ভাস্বর হতে দেখি ।
       একটি চারাগাছের শরীর যেমন মাটি ও বাতাসের আদরে সেই পরিমন্ডলসুলভ ফুল-ফলে সেখানকার শোভা বৃদ্ধি করে ,একজন বিশুদ্ধ কবি ঠিক তেমনই ।যেখানে সে লালিত-পালিত, সেখানের জয়গান দিয়েই শুরু হয় তাঁর পথ হাঁটা । এটাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক সুখের-অসুখ ।আমেরিকার অত্যুৎকৃষ্ট  সৌন্দর্য বিস্তীর্ণ সীমানা ও মানুষের প্রাণে হেঁটে  হেঁটে কিভাবে কবিও এই গভীর অসুখে পড়ে যান---


I hear America singing,the varied carols,I hear
Those of mechanics,each one singing his as it should be blithe and  strong.
The carpenter singing  his as he measures his plank or beam,
The mason singing his as he makes ready for work,or leaves off work .
                                                                  [ I Hear America Singing]

            দেশপ্রেমে বুঁদ কবি যখনই স্বাদহীন  করে তোলেন তাঁর   কবিতাকে ,কারা তখন তাঁর মাথায় পরিয়ে দেয় কন্টকময় মুকুট । তবু কি রক্তাক্ত হয় তাঁর মাথা ? হয়তো হয় অন্য কোথাও ............!! মানুষের জীবন নিয়ে পাশবিক অপচয়ে মগ্ন গৃহযুদ্ধরত স্বদেশের প্রতি মর্মাহত কবির বেদনাগ্রস্থ হৃদয় থেকে সাদা পৃষ্ঠায় গড়িয়ে পড়া রক্তে কিভাবে সম্পূর্ণ করেছেন শোকাহত বাবা-মায়ের হারানো পুত্রের বিষয়ে খবর নিতে আসা  হৃদয় বিদারক নাটকীয় চিত্রনির্মাণকে -
The only son is dead.
But the mother need to be better,
She with thin form presently drest in black,
By day her meals untouched,then at night fitfully sleeping often waking,
In the midnight waking,weeping,longing with one deep longing....

         
              আততায়ীর আঘাতে চিরশায়িত জাতির নায়ক আব্রাহ্যাম লিঙ্কনের প্রতি তাঁর নিদারুণ বিলাপ  হয়ে উঠেছে এক আশ্চর্য শোকগাঁথা ।এক দিকে দেশ জয়ের আনন্দ আর অন্য দিকে দেশের পুত্রকে হারানোর মর্মস্পর্শী বেদনা--এ দু'য়ের   সাহসী বৈপরীত্যের সংমিশ্রণ দেখি তাঁর কলমে । 'O Captain' কবিতাটিতে  লিঙ্কনকে সম্মোধন করে তাঁর পুনর্জীবনের আহ্বানের মধ্যে খুঁজে পাই কবির ঐকান্তিক আর্তি ।তাঁর ব্যক্তিগত আস্ফালনের গভীরতা কবিতাটির ছত্রে ছত্রে ----
My Captain does not answer,his lips are pale and still
My father does not feel my arm,he has no pulse nor will.
                                                                    [ O Captain]

           হুইটম্যানের কাব্যরাজ্যে এসে গঙ্গোত্রীর পাশে দাঁড়ালেই দেখি নদীর মতো নারীর তরঙ্গ-চিত্রে আমার সেরে ওঠা অন্ধত্বের গ্রন্থিমোচন পর্ব ।তরঙ্গে কখনও তিনি আত্মিক,কখনও-বা শারীরিক । কখনও বর্বর ,কখনও দেবদূতসুলভ গায়ক ।পার্থিব সুখানুভূতির বাইরে মানসলোকেই প্রিয়জনের সাথে মিলনের অস্তিত্ব স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বাস্তব  থেকে  পালিয়ে না যাওয়ার নাছোড়বান্দা মনোভাবে পাই  স্ববিরোধীতার ইঙ্গিত ।ইন্দ্রিয় সুখানুভূতিতে তিনি মত্ত ।হয়তো তিনি উগ্র যৌনভূক । হয়তো স্বাভাবিকতায় তিনি অস্বাভাবিক ,উন্মাদ ।অথচ তাঁর প্রকাশভঙ্গি কত শ্লীল ।আর এই উন্মাদনায় আমিও কি চাইনি একটি পবিত্র বাসরঘর ,ফুলের মতো শরীরের সুবাসিত ঘ্রাণ ,আর ঝরের রাতে নক্ষত্রের দেশে আমাদের পোশাকমন্ডলীর শান্ত ভ্রমণ----
A woman waits for me , she contains all,nothing is lacking,
Yet all were lacking  if sex were lacking,or if the moisture  of right man
                                                                                                were lacking.
She contains all,bodies,souls
Meanings,proofs,purities,delicacies,results,promulgations,
Songs,commands,health,the mental mystery,the seminal milk,
....................................................................................................
.................................................................................................
Without shame the man I like knows and avows the deliciousness of his sex
Without shame the woman I like knows and avows her.
                                                 [ A Woman waits for Me]

           প্রকৃতিবাদীদের মতো ঈশ্বরের উপস্থিতি অস্বীকার বা অন্ধবাদীদের মতো ঐশ্বরিক বিষয়ে সম্যক  ধারণার বশবর্তী না হয়ে হুইটম্যান আত্মোপলব্ধিতেই খুঁজেছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব ।ব্যক্তিসত্তার সাথে মহান ব্রহ্মার [মহান  আত্মা ] একাত্মতার মধ্যে দেখি তাঁর কবিতায় বেদান্ত দর্শন ও সুফি কবিতার প্রত্যক্ষ প্রভাব --
 O my brave soul!
O farther farther sail !
O daring joy,but safe! are they not the seas of God?
O farther,farther,farther sail!

                 হুইটম্যানের  কবিতা সংকলন "Leaves of Grass"-এর নামকরণে অনেকটাই আত্মিক প্রতিকীরূপ দেখি ।সাধারণ ঘাস ,যা কিনা ঈশ্বরের রুমাল,সর্বময় পরিব্যপ্ত,বিশ্বব্রহ্মান্ডের অমর আত্মা ।
                           'The Sleepers' কবিতায় কবি স্বপ্নলোকে নিশাচরের মতো পরিভ্রমণরত ।এখানে রাত [Night]  ও ঘুম[Sleep] শব্দদ্বয়ে তাঁর মৃত্যুচেতনার সংকেতধ্বনি  বেজে ওঠে ।আবার কোথাও কবি একজন নিঃসঙ্গ গায়ক [As I Edd'd With the Ocean of Life] ,প্রেমিকাকে হারানোর বেদনায় ক্রুদ্ধচিত্তে একাকী গাইছেন

,যা আঁধারের অতল  গহ্বরের অভিজ্ঞতার মতো মর্মস্পর্শী  হয়ে উঠেছে ।
              সমকালে কারো কারো কাছ থেকে পাওয়া অ-কবির শিরস্ত্রান এবং  মৃত্যুপরবর্তী শতাব্দীতে নতুন প্রজন্মের কবিদের কবিতায় তাঁর প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখে মনে হয় 'সমকাল' মাঝে মাঝেই প্রকৃতকে চিনতে বড় বেশি ভুল  করে ।এ রকম আর কতো ভুলের সাথে আমরা আবারও জড়িয়ে পড়ব !
          এ ভ্রমণ অসমাপ্ত। তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের একটি পরগনায় এ ভ্রমণ  ।অধরা তো থাকবেই ।


  উৎসমুখঃ--
     1.A History of American Literature:Mary S..David & R.L.Varshney
      2.Whitman's Poetic Leaves:Chidananda Bhattachariya
      3.Leaves of Grass:A Norton Critical Edition


=======================================================
   

ছোটগল্প
                                                                                    মাতৃত্বের অহংকার 
                                                                                         অরবিন্দ দত্ত

                   অলি আফিসে আমাকে ফোনে বলল,তিতির এখনো স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি তুমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসো ফোনে খবরটা শোনা মাত্র  আমি দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রায় ঝড়ের গতিতে বাইক চালিয়ে বাড়িতে পৌঁছালাম জীবনে কোনদিন এতো জোরে বাইক চালাইনি
           তিতির আমাদের  একমাত্র মেয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে আমারই এক চেনাশোনা  রিক্সাওয়ালা গোবিন্দ ওকে নিয়মিত  স্কুলে পৌঁছে দেয়  ,আবার নিয়ে আসে  ইদানিং গোবিন্দর  সাথে তিতরের খুব  বন্ধুত্ব  হয়েছে গোবিন্দ তিতিরকে খুব স্নেহ করে ও ভালোবাসেসে তিতির কে দিদিমণি বলে ডাকে হাজার  ঝড়বৃষ্টিতেও গোবিন্দ তিতিরকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসে আর তিতিরসেও  তাঁর গোবিন্দ কাকুর  রিক্সা ছাড়া অন্য কোন রিক্সায় স্কুলে যেতে চায়  না প্রথম প্রথম অলি  গোবিন্দর রিক্সাতে তিতিরকে স্কুলে পৌঁছে দিত আবার নিয়ে আসতো একদিন গোবিন্দই অলিকে বলেছিল, বৌদি আপনাকে  আসতে হবে না আমিই দিদিমণি কে  স্কুলে দিয়ে আসবো আবার নিয়ে আসবো  অলি একা তিতিরকে গোবিন্দর  রিক্সায়  পাঠাতে চাইছিল না   গোবিন্দ বুঝতে পেরে বললভাববেন না বৌদি, আমি দিদিমণিকে  ঠিক মতো নিয়ে যাব আমারও দিদিমণির বয়সি একটা মেয়ে আছে পরে একদিন আমি গোবিন্দর বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে ওঁর  বাড়িটা দেখে এসেছিলাম এখন গোবিন্দ তিতিরকে  স্কুলে  নিয়ে যাওয়া-আসা ছাড়াও  আমাদের অন্যান্য  টুকটাক কাজকর্ম  মাঝে মধ্যে করে দেয় ধীরে ধীরে ও আমাদের বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে এমনিতে গোবিন্দ খুব কর্তব্যপরায়ণ
                        বাড়িতে  ঢুকতেই অলি  কাঁদতে কাঁদতে বললদেরি হচ্ছে দেখে আমি তিতিরের স্কুলে গিয়েছিলাম   স্কুলের দারোয়ান বললআপনাদের রিক্সাটা এসে আপনার মেয়েকে আধ ঘণ্টা আগে নিয়ে গেছে এখনতো স্কুলে কেউই নেই স্কুল অনেকক্ষণ আগেই ছুটি হয়ে  গেছে তারপরই আমি তোমাকে ফোন  করি
                             একেতো তিতিরের কোন খবর নেই তার উপর আলিও সমানে কেঁদে  চলছে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না একবার মনে হল থানায় যাই তারপরই  হটাৎ আমার গোবিন্দর বাড়ির কথা মনে পড়ল একবার অন্তত গোবিন্দর বাড়িতে গিয়ে দেখলে  হয় ভাবছি সত্যিই কি গোবিন্দ আমাদের এতোবড়ো সর্বনাশ করবে আমি তাড়াতাড়ি ড্রয়ার থেকে ডয়ারি বের করে গোবিন্দর ঠিকানা লেখা পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে  পকেটে পুড়লাম অলিকে বললাম, আমি গোবিন্দর বাসায় যাচ্ছিভ আমার কথা শুনে অলি বলল, আমিও তোমার সাথে যাবো
                           গোবিন্দ শহর থেকে কিছুটা দূরে এক বস্তিতে থাকে প্রায় এক বছর আগে গোবিন্দর দেওয়া ঠিকানার সত্যতা যাচাই করার জন্য আমি  গোবিন্দর বাড়িতে এসেছিলাম   বাড়ি বলতে দড়মার বেড়া দেওয়া একটা  টিনের চালের ঘ গোবিন্দ আমার সাথে ওঁর বউ -এর পরিচয়  করিয়ে দিয়েছিল   সেদিন  গোবিন্দর মেয়েটাকে দেখেছিলাম তিতিরের বয়সি হবে দেখতে বেশ সুন্দর নাম জিজ্ঞেস করাতে মেয়েটি বলেছিল, পিউ দাস বাবার নাম গোবিন্দ দাস এইতো আট মাস আগে তিতিরের জন্মদিনে বউ-মেয়েকে নিয়ে গোবিন্দ আমার বাড়িতে এসেছিল গোবিন্দর মেয়ে পিউ  গুটি গুটি পায়ে  এগিয়ে এসে তিতিরের হাতে  একটা পুতুল দিয়ে বলেছিল,এটা তোমার অলি গোবিন্দকে ধমক দিয়ে বলেছিল, এটা কেন তুমি তিতিরের জন্য আনতে গেলে?  উত্তরে গোবিন্দ বলেছিল, 'দিদিমণি' আমার মেয়ের  মতোই এটা তো সামান্য একটা পুতুল এর চেয়ে বেশি কিছু দেবার ক্ষমতা আমার নেই আপনি না বলবেন না বৌদি সেই গোবিন্দই কিনা  শেষে আমাদের  এমন বিপদে ফেলবে আগে গোবিন্দকে হাতে পাই, তার পর .....এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বস্তির বিভিন্ন গলি-ঘুপচি ঘুরে গোবিন্দর বাড়ির গলির মুখে আসতেই দেখি, গোবিন্দ  ওঁর মেয়ে পিউ আর তিতিরকে  রিক্সায় বসিয়ে গলি দিয়ে বেড়িয়ে আসছে বাইকটা  থামাতেই  অলি বাইক থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে রিক্সার সীটে বসে থাকা তিতিরকে কোলে তুলে  নিলো আমাদের দেখে গোবিন্দ অবাক হয়ে গিয়েছিল আমি বাইকটা  দাঁড় করিয়েই  ওঁর দিকে  ধেয়ে  গেলাম  ইতিমধ্যে আমাদের চারপাশে বস্তির লোকজন জমতে শুরু করে দিয়েছে আমি গোবিন্দর জামার কলারটা ধরে  জিজ্ঞেস করলাম, এটা তুই কেন করলি  গোবিন্দ? কেন তুই তিতিরকে তোর বাড়িতে নিয়ে এসেছিস? তিতিরের জন্য আমাদের  দুজনকে  আজ এক দুর্বিসহ মানসিক  দুশ্চিন্তার  মধ্যে কাটাতে হয়েছে দেখলাম গোবিন্দর চোখদিয়ে জল পড়ছে অলি বলল, ওকে মেরো না, ছেড়ে দাও আমরা তিতিরকে পেয়ে গেছি আমি গোবিন্দর জামার কলারটা ছেড়ে দিলাম
                        হঠাৎ গোবিন্দ আমার পা  জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিন আমি বাধ্য হয়েই দিদিমণিকে এখানে নিয়ে এসেছি আমার বৌ'টা আজ মাড়া গেছে কয়েক দিন ধরে জ্বরে ভুগছিল গতকাল রাত্রে জ্বর আরও বেড়ে যাওয়ায় আজ  ভোর বেলায় হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম স্কুল ছুটির পর দিদিমণিকে  নিয়ে আপনার বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম  পথে  আমাদের  বস্তির একজনের  সাথে  দেখা হল ,যাকে আমি হাসপাতালে রেখে  দিদিমণির স্কুলে এসেছিলাম সে   বলল, তোকে এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে তোর  বৌ-এর অবস্থা  খারাপ বিশ্বাস করুন, খবরটা শোনার পর আমার মাথার ঠিক ছিল না আমি রিক্সা ঘুরিয়ে সোজা হাসপাতালে যাই গিয়ে দেখি সব শেষ আমার বৌ আর নেই   তার পর  দিদিমণিকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি ঠিক করলাম  দিদিমণিকে আগে ওঁর বাড়িতে পৌঁছে দেবো তার পর  মেয়েকে নিয়ে  হাসপাতালে যাব দিদিমণিকে  নিয়ে  এখন আমি আপনদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম
                      ছিঃ এ আমি কি করলাম ! যে মানুষটার এখন তার বউ-এর মৃত দেহের  কাছে থাকার কথা, যে কিনা আমার মেয়েকেই পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল, আর আমি তাকেই  মারতে যাচ্ছিলাম !  অলি আমাকে না থামালে আমিতো গোবিন্দকে মেরেই দিতাম গোবিন্দকে দুহাত দিয়ে ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে ক্ষমা করো গোবিন্দ আমি বুঝতে পারিনি যে, তোমার এতো বড় একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে   পিউ বাবাকে কাঁদতে  দেখে সেও কাঁদতে লাগলো অলিকে দেখলাম, তিতিরকে কোল থেকে নামিয়ে রিক্সায় বসা  পিউকে কোলে তুলে নিল তারপর গোবিন্দর কাছে এসে বলল, আর দেরি কোর না গোবিন্দ শেষবারের  মতো তোমার মেয়েকে ওঁর মায়ের কাছে নিয়ে যাও আমি পকেট থেকে দুটো হাজার টাকার নোট বের করে গোবিন্দর হাতে দিয়ে বললাম, এই টাকাটা রাখো গোবিন্দ সে কিছুতেই টাকাটা নিতে চাইছিল না আমি জোর করে ওঁর  পকেটে টাকাটা গুঁজে দিয়ে বললাম, এখন আমরা আসছি পরে আমার সাথে দেখা  করো
                        সেদিন আমি আর অলি, কেউই আমরা সারারাত ঘুমোতে পারি নি  চোখ বন্ধ করলেই, চোখের সামনে গোবিন্দ আর ওঁর মেয়ের কান্না  দেখতে পাচ্ছিলাম ঠিক মতো আফিসের কাজেও মন বসাতে পারছিলাম না
                          এর  দিন পনেরো পর  একদিন আফিসে  যাবার আগে অলি  আমাকে বলল, আজ তোমাকে একটা  সারপ্রাইজ দেবো আমি বললাম  সারপ্রাইজটা ক? অলি বলল, সেটা তুমি আফিস থেকে  ফিরে এসেই দেখতে   পাবে যথারীতি আফিস থেকে ফিরে  ড্রয়িং রুমের সোফায় সবেমাত্র দেহটা এলিয়ে দিয়েছি, তিতির বাবা বলে দৌড়ে  এসে আমার কোলে বসল সঙ্গে সঙ্গে  দেখি  গোবিন্দর মেয়ে পিউও দৌড়ে এসে আমার থেকে কিছুটা দূরে থমকে দাঁড়িয়ে  গেল এই সময় এখানে পিউকে দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম কেমন সারপ্রাইজ দিলাম! কথাটা শুনে তাকিয়ে  দেখি অলি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে অলি বলল, আমি আজ পিউকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছি এখন থেকে ও আমাদের সাথে এখানেই থাকবে এবং তিতিরের সাথে স্কুলে যাবে আসলে, এই কয়দিন আমি কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলাম না   চোঁখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাই, পিউ মা-মা  করে কাঁদছে তাই  ঠিক করলাম, পিউকে আমার কাছে এনে রাখবো  ওকে আমি মানুষ করবো   গোবিন্দও রাজি হয়েছে তুমি  খুশি হয়েছো?
                     আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম কোন কথা বলতে পারলাম না গত কয়েকদিন  ধরে যে কথাটা আমি মনে মনে ভাবছিলাম এবং যেটা অলিকে পর্যন্ত বলতে পারিনি, সেটাই আজ অলি করে দেখিয়ে দিল একেই বলে মায়ের মন এটাই বুঝি মাতৃত্বের  অহংকার  আজ আরও একবার  সেই অহংকার  জিতে গেল এই অহংকার করা যে  অলির অধিকার অলির মুখমণ্ডলে মাতৃত্বের এক নতুন আনন্দচ্ছটা দেখতে পেলাম
       আমি  পিউকেও  কোলে তুলে নিলাম অজান্তে আমার দুচোঁখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল তিতির আর পিউ দুজনেই তাদের  কোমলদুটো হাত দিয়ে আমার দু চোখের জল মুছে দিতে লাগল.....
 
---------------------------------------------------------



 ছোটগল্প                                 
                                                মশিউর রহমান শান্ত
                                                       কালো ছায়া
                                              
                    গ্রামটির নাম গোয়াল বাথান কালিয়াকৈর বাজার থেকে বেশ দরে বাজার থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছে যাওয়া যায় গ্রামটিতে সন্ধ্যা হয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ আগে । বাজার থেকে কেনা এক হাড়ি দই এবং অন্য হাতে মোবাইলের আলো ফেলতে ফেলতে সামনের দিকে এগোচ্ছিল আশপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার অন্ধকারের মাত্রা এত বেশি কেন তা আশরাফ বুঝতে পারছে না কোনো বাড়িতেই কোনো রকম আলো দেখা যাচ্ছিল না গ্রামের মানুষদের চাল-চলন কিছুই বুঝে উঠতে পারে না আশরাফ ঢাকার এত কাছেই যে এ রকম জংলা অজপাড়া আছে তা এখানে না এলে সত্যিই বোঝা কঠিন ছিল সে এখন যাচ্ছে তার শ্বশুরবাড়িতে হেনা একা নয়, সঙ্গে রয়েছে তাদের প্রথম সন্তান মৃদুলাও যার বয়স মাত্র পনেরো দিন আশরাফের ঢাকার ফ্ল্যাটে কেউ দেখাশোনার নেই ।  প্রায় বাধ্য হয়েই সে মেয়ে মৃদুলা ও স্ত্রী হেনাকে এই জংলা গ্রামে রেখেছে তবে এ ব্যাপারে হেনা খুব খুশি কেননা বাচ্চার অছিলায় হলেও তো সে তাঁর মায়ের কাছে থাকতে পারছে সে ঠিক করেছে প্রায় দুই মাস এখানে থাকবে বাচ্চাকে নিয়ে কোন ধরনের চিন্তা তাকে করতে হবে না মৃদুলা কান্নাকাটি করলে বা বিছানা পরিস্কার করার জন্য তাঁর মা এবং ছোট বোন আদ্রিই যথেষ্ট সমস্যা একটাই, এখানকার মানুষ রাত হলেই ভূতের গল্প শুরু করে, যা মোটেও ভালো লাগে না তার এমনকি মাঝে মাঝে ভয়ের কারণে রাতে ঠিকমত ঘুমোতেও পারে না সে বাইরে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে বুঝতে পারল আশরাফ এসেছে হেনা ঘর থেকে বের হতে পারবে না সন্ধ্যার পর তাঁর ঘর থেকে বের হওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ আর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন তাঁর মা শাহানা বেগম এদিকে আশরাফ তার শ্বশুরবাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একধরনের অস্বস্তি বোধ করতে লাগল তাকে দেখে গ্রামের কয়েকজন মহিলা অকারণেই মাথায় ঘোমটা দিয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে লাগল মহিলাগুলো অপরিচিত; আগে তাদের দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না কিছুক্ষণ পরই তড়িঘড়ি করতে লাগলেন এবং বার বার বলতে লাগলেন, বাবা যাও, কলপাড়ে যাও, হাত-মুখ ধুয়ে আসো আশরাফ বলল, মা, আমি এক্ষুনি হাত মুখ ধুতে যাচ্ছি তার আগে বলেন, হেনার খবর কি? তাঁর শরীর ভালো তো? আমার মেয়ে মৃদুলা কেমন আছে? আমি তো এক সপ্তাহ কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য আসতে পারিনি শাহানা বেগম জামাইকে বললেন, তোমার বউ, মাইয়া বেবাকে ভালাই আছে তুমি যাও, আগে হাত-মুখ ধইয়া আসো বাবা আশরাফকে হাত-মুখ ধোয়ার কথা বলেই শাহানা বেগম তাঁর ছোট মেয়ে আদ্রিকে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলেন, এই আদদিরি, এদিকে আয় তোর দুলাভাইয়ের কলা চাইপা দিয়া যা তিনি তার ছোট মেয়ে আদ্রিকে, আদ্রি নামে ডাকতে পারেন না তার উচ্চারণে সমস্যা হয় তিনি ডাকেন আদদিরি  
                           রাতের খাবার শেষ করার পর আশরাফের খুবই মেজাজ খারাপ হলো আর হবেই না বা কেন? এত দূর থেকে এসে যদি বউ বাচ্চার সঙ্গে কথাই না হয়, তাঁর পনেরো দিনের ছোট্ট শিশু মৃদুলার মুখটাই যদি দেখতে না পায় তাহলে এত কষ্ট করে আসার কি কোনো অর্থ হয়? বিয়ের পর পর আশরাফ পরিকল্পনা করে রেখেছিল, তার মেয়ের নাম হবে মৃদুলা আর ছেলের নাম রাখা হবে জোনাক তার পরিকল্পনা আজ বাস্তবে ধরা দিয়েছে তার মেয়ে মৃদুলার জন্ম হয়েছে পনের দিন আগে আর এখন তাঁর শ্বাশুড়ি বলছেন, তাদের সঙ্গে রাতে কথা বলা যাবে না, সকালে কথা বলতে হবে আশরাফ বিরক্তমুখে শাহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, আম্মা রাতে হেনার সঙ্গে কথা বললে ক সমস্যা সেটা তো বুঝতে পারছি না শাহানা বেগম আশরাফের কিনে আনা দই বাটিতে ঢালতে ঢালতে বললেন, বোঝো না ক্যান বাবা, আতুড়ঘরে রাইত কইরা যাইবা, ছুইত-ছোয়া লাইগা যাইতে পারে আশরাফ বিরক্ত মুখে বলল, ি যে বলেন আম্মা, আপনারা এখনো এসব বাজে কুসংস্কার নিয়ে পড়ে আছেন? শাহানা বেগম বললেন, আরে বাবা ব্যাপার আছে বুঝো না ক্যান, আমি তোমাদের মা ,আমি ভালোর জন্যই বলছি বাবা কি ব্যাপার? কিসের ভালোর জন্য আম্মা? খুলে বলেন তো? এসব তুমি বুঝবা না বাবা এখানে কিছু মেয়েলি ব্যাপার আছে আর আমাগো অঞ্চলে ছুইত-ছোওয়া লাগলে ছোট পোলাপাইনের ওপর ল্যাংড়ি চড়াও দেয় ল্যাংড়ি চড়াও দেয় মানে কি? আছে, খারাপ জিনিস একটাই তো রাইত বাবা তুমি বরং ঘুমাও আইজ রাইত  
         আশরাফ বিরক্ত মুখে ঘুমাতে গেল এবং সকালে উঠে হেনার সঙ্গে কথা বলে মেয়েটাকে কিছুক্ষ আদর করল এবং কোলে নিয়ে বসে থাকল কিছু সময় পর আশরাফ ঢাকায় রওনা দেবার উদ্দেশ্যে তৈরি হলো অফিস থেকে জরুরি ফোন এসেছে, তাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে সে যাবার আগে হেনাকে বলে চলে গেল, এখানে অনেক থাকা হয়েছে আর বেশিদিন থাকার দরকার নেই সামনের শুক্রবারে তৈরি হয়ে থেকো আমি এসে তোমাদের নিয়ে যাব এই জায়গাতে বেশি সময় থাকলে তুমিও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে
                    আশরাফ সকাল এগারোটার দিকেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিল আর সেদিন রাতেই হেনার জীবনে ঘটে গেল অদ্ভুত এক ঘটনা হেনা রাতে ঘুমাচ্ছিল রাত একটা বা দেড়টা হবে তার পাশে মেয়ে মৃদুলা ও বোন আদ্রি ঘুমিয়েছিল এমন সময় হঠাৎ করেই চেয়ারের শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল চোখ খুলে হেনা খুবই অবাক হলো কারণ সে স্পষ্ট দেখল তাঁর সামনে কেউ একজন দাড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকে ও মৃদুলাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে আবছা আলোতে হেনা পরিস্কারভাবে দেখছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি একজন মহিলা এবং সে কালো রঙের শাড়ির মতো গায়ে কিছু একটা জড়িয়ে আছে হেনা ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে আদ্রিকে ডাকতে লাগল হেনার কণ্ঠ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই দাড়িয়ে থাকা মহিলাটি দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল হেনা পরিস্কার দেখতে পেল, মহিলাটা ল্যাংড়া এবং সে ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হেনার এ দৃশ্য দেখে যে কেবল ভয় হলো তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে তার গলা শুকিয়ে, হাত-পা অবশ হয়ে যাবার উপক্রম হলো আর তখনই আদ্রি ঘুম থেকে উঠে বলল, আপা, কি হয়েছে? এত চিৎকার করছ কেন? হেনা নিজের অজান্তেই অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ করছিল আদ্রির ডাকে সে চিৎকার বন্ধ করে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, আমি ভয় পেয়েছি ভীষণ ভয় পেয়েছি তুই আমার বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে থাক্ আমার ভীষণ ভয় করছে এরপর সারা রাত দুই বোন বলতে গেলে জেগেই কাটিয়ে দিল       
                            পরের দিন হেনা তার মাকে রাতের ঘটনা বলার সঙ্গে সঙ্গেই শাহানা বেগমের মুখ ভয়ে পাংশু বর্ণের হয়ে গেল কারণ তিনি বুঝতে পারছেন মেয়ের মুখের বর্ণনা অনুযায়ী লক্ষণ খুবই খারাপ এই অঞ্চলে কারো নতুন বাচ্চা হলে সবাই যে জিনিসটার ভয় পায় তা হচ্ছে এই ল্যাংড়ি কারণ কথিত আছে যে, সেই বাড়ির বাচ্চা একটা হলেও মারা যায় তবু তিনি মেয়ের কাছে এসব প্রকাশ না করে মেয়েকে বললেন, চিন্তা করিস না, আমি আইজ রাইতে তোর ঘরে থাকুম যথারীতি রাতে ঘুমানোর সময় শাহানা বেগম মেয়ের ঘরে চলে এলেন সারা রাত কেউ ঘুমাবে না ।  বাচ্চাকে কোলে নিয়ে পাহারা দবে , যাতে বাচ্চার কোন রকম ক্ষতি কেউ করতে না পারে তারা সারারাত জেগে থেকে সব কিছুর প্রতি লক্ষ্য রাখল কিন্তু রাতে কেউই কিছু দেখল না অথবা কোন কিছুর ব্যতিক্রম কিছু ঘটল না হেনা সারা রাত নানারকম দুঃশ্চিন্তা করে কাটলো এবং মনে মনে ঠিক করে রাখল যে, দুএক দিনের মধ্যে আশরাফ এলে সে ঢাকায় চলে যাবে সে সকালে আশরাফকে ফোন করে কথা বলল কিন্তু রাতের ঘটনা কিছুই স্বামীকে জানাল না পাছে আশরাফ তাকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে বিব্রত করে যাই হোক এই রাত গেল ভালোভাবেই তাঁরা তিনজন একসঙ্গে থাকার জন্যই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক কেউ যেন কোন কিছু দেখল না তেমনি কঠিন ভয়ও পেল না  
                পরদিন হেনার ভয় কিছুটা কমে যাওয়ায় সে স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগল তাঁর কাছে বিষয়টা রহস্যকর বলে মনে হতে লাগল সে রাতে যে ল্যাংড়া মহিলা দেখে ভয় পেয়েছিল তা হেনার দেখার ভুল বলে মনে হতে লাগল দুপুরের খাবার পর হেনা মৃদুলাকে  কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল এবং মৃদুলার পাশে শুয়ে মেয়েকে মজার মজার গল্প শোনাতে লাগল একটা সময় হেনা গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল এবং সে ঘুমের মাঝেই দেখতে পেল তাঁর ঘরে চুপি চুপি এক মহিলা ঢুকে তার মেয়ে মৃদুলাকে কোলে নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে হেনা সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠে দেখল, মৃদুলা তার পাশে শুয়ে হাত-পা নেড়ে খেলা করছে হেনা বুঝতে পারল না যে তার দুপুর বেলায় ক্ষণিকের দেখা স্বপ্নের পরিণাম যে এতটা ভয়াবহ হবে স্বপ্নের মাঝে তাঁর ছোট্টমণিকে নিয়ে যেতে দেখেছে বলেই যে বাস্তবে এরকম মাশুল দিতে হবে বিকেলের মধ্যেই তার আদরের মেয়ে মৃদুলা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ হয়ে যায় এবং সন্ধ্যার দিকে মৃদুলা মায়ের কোল ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি জমায় কোন কারণ ছাড়াই সে চলে গেল অজানার পথে ডাক্তাররা তার মৃত্যুর কারণ বের করতে পারল না হেনার চোখে কেবলই ভেসে ওঠে সেই ভয়ার্ত স্বপ্নের কথা যা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু
----------------------------------------------------------------------------------------
 

রিভিউ[বই /নাটক]



                                                                    নাট্য সমালোচনাঃ

                                              ভাঙা ঘরের খেলা এবং   'ও'-কমপ্লেক্স
                                                       অমিত কুমার বিশ্বাস



               রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ইয়ার্কি-ফাজলামি যে বাঙালিরা আজও খুব একটা পছন্দ  করেন না তার  সাম্প্রতিকতম নিদর্শন হল কিউ-এর 'তাসের দেশ' সিনেমা হোক বা থিয়েটার,রাবীন্দ্রিক সেন্টিমেন্টকে সুন্দরভাবে পরিবেশন করার ক্ষমতা রাখেন এমন খুব কম ছিলেন বা আছেন বললেও অত্যুক্তি করা হবে না বোধহয় 'গোবরডাঙা নকসা'-আশিস দাস এই দ্বিতীয় পংক্তির-
একজন

             সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস -এ পরিবেশিত হল তাদের সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ঘরে বাইরে'এই প্রযোজনা সত্যজিৎ -প্রভাব মুক্ত ,ষোলোয়ানা সাবেকি বাঙালিয়ানা ভাবাবেগে পরিবেশিত এবং সমসাময়িক আন্তর্জাতিক অসহিষ্ণুতার  পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক এখানে 'ঘর' 'বাহিরের' মধ্যে আশিস দাস বাইরের জগৎ-এর উপর বেশি জোর দিয়েছেন তবে নাটকটিতে  উপন্যাসের মূল সুরকে অত্যন্ত সুচারুভাবে  ধরবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা করেছেন নাট্য-রূপকার অরিন্দম সেনগুপ্ত তবে তিনি কিছুটা স্বাধীনতা গ্রহণ করতেই পারতেন অনুষঙ্গে কিছুটা সাহস কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেননি

               রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নারী' চরিত্রকে মঞ্চে  যথাযত ভাবে উপস্থাপন করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার পূর্বসূরীরা ঠারে ঠারে  টের পেয়েছেন,আশিসও এর ব্যতিক্রম নন তবুও তিনি সে যুদ্ধে সফল ;আর তাঁর দিকে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বিমলার ভূমিকায় দ্বিপান্বিতা বণিক দাসের সুনিপুন অভিনয় নাটকের স্বার্থেই সন্দিপ এখানে 'মেকিয়াভেলিয়ান ভিলেন'  ,আর  মুরারী মুখোপাধ্যায় সে কাজে যথার্ত তাঁর ক্রূর চাউনি,কামুক অভিব্যক্তি ও কন্ঠের মাদকতা
এককথায় অনবদ্য বৌঠানের চরিত্রে প্রবীণ অভিনেত্রি নীলিমা সেনগুপ্তের মঞ্চে উপস্থিতি দর্শকদের   মোহিত করে বিমলার "খোঁপা বাঁধা"  প্রসঙ্গে তাঁর তীক্ষ্ণ শ্লেষ নাটকটির একটি চমৎকার মুহূর্ত এ ছাড়া মাস্টারমশাই-এর চরিত্রে অনিমেষ ভট্টাচার্য্য নিখিলেশের চরিত্রে অজিত সাহার অভিনয়ও বেশ ভালো ছোট চরিত্রদের মধ্যে পাঁচুর ভূমিকায় অনিল মন্ডলঅমূল্যের ভূমিকায় শুভঙ্কর দে-কেও মনে রাখার মতো 'Crowd' -এর প্রতিটি দৃশ্যই সুনিপুনভাবে সম্পাদিত ;বিশেষ করে নৌকা ডুবিয়ে দেবার দৃশ্যটি চমৎকার
 


             সঞ্চয়ন ঘোষের বুদ্ধিদীপ্ত মঞ্চপরিকল্পনা,বিমল দাসের আলো ও স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহ নাটকটির ভাব ও ভাবনার  সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ।এ ছাড়া দেবাশিস দত্তর পোশাক ও পঞ্চানন মান্নার সাজ উপন্যাসটির সাবেকিয়ানাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয় তবে যোগ্য রাঁধুনির হাতে 'ঘরে বাইরে' সুস্বাদু হয়ে উঠলেও নাটকটির প্রথম পর্ব কিছুটা  হলেও  তত্ত্বভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে

            সম্প্রতি নজরুল মঞ্চে পরিবেশিত হল  'কয়াডাঙা সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র'-এর পরিচালনায় সোফোক্লেসের 'রাজা ওইদিপৌস ' এরকম বিশ্বমানের ক্লাসিককে মঞ্চস্থ করা যে সহজ কথা নয় তা যারা তাতে হাত দিয়েছেন কেবল তারাই জানেন অনেকেরই হাত পুড়েছে কপালও এহেন প্রোডাকশানে হাত দেবার সাহস রাখার জন্য বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন তরুণ পরিচালক রাজেশ দেবনাথ তাঁর 'adaption' দারুণ রাজেশ এখানে Brecht-এর 'theory' মেনে দর্শকদের বারংবার অবগত করতে লাগলেন যে তাঁরা সত্যিই এক সুদূর অতীতের ঘটনা দেখছেন মাত্র নাতাঁরা অতীতে হারিয়ে যান নি একদমই    অগত্যা  জিনস-টিশার্ট পরা এক আধুনিকা ডায়েরি হাতে অবতীর্ণ  ন্যারেটরের ভূমিকায় সাবেকিয়ানায় পরিবেশিত নাটকটিতে ভেসে আসে সুদূর গ্রীসের ঘ্রাণ এখানে রানী ইওকাস্তার ভূমিকায় নবমিতা ঘোষ  বেশ ভালো অভিনয় করেছেন তবে রাজার চরিত্রে রাজেশ দেবনাথ কিছুটা নিষ্প্রভ ,বিশেষ করে তাঁর কন্ঠস্বর ওইদিপৌসের  ব্যক্তিত্বের সঙ্গে  সামঞ্জস্যপূর্ণ  হয়নি  ক্রেয়নের ভূমিকায় সৌভিক ভট্টাচার্য্যও ভালো তবে ছোট চরিত্রগুলি বেশ ভালো প্রাজ্ঞের ভূমিকায় উজ্জ্বল মন্ডল,তেইরেসিয়সের ভূমিকায় সুরজিত মজুমদার এবং মেষপালকের ভূমিকায় সাইমন টুডু অসাধারণ আর এই নাটকের সব থেকে বড় প্রাপ্তি ছায়া [রাজা ওইদিপৌসের বিবেক ]-র ভূমিকায় সুভজিত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কয়েক মুহূর্তের অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের বহুদিন মনে থাকবে নাটকের কোরাস অত্যন্ত নৈপুন্যের সাথে সম্পাদিত ও পরিবেশিত এ ছাড়া সুভিজিত গুহর আবহ ,রাজেশ দেবনাথের আলো এবং নীল কৌশিকের মঞ্চসজ্জা নাটকের 'tension' 'soul' -এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তবে  থিয়েটার হলটিতে শব্দ নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে আরো বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল

---------------------------------------------------------------------   
    'বিদর্ভ '-নাট্যদলের প্রথম প্রয়াস 'বিদর্ভ নাট্য পত্র' ।এই নাট্য পত্রে দুটি নাটকের রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে ।রিভিউ দুটি এই অধমেরই করা ।একটি 'গোবরডাঙা নকসা'-র 'ঘরে বাইরে' এবং অপরটি কয়াডাঙা সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র'-'রাজা ওইদিপৌস' ।আমার দুষ্পাঠ্য হাতেরলেখার জন্য লেখাটির কয়েকটি স্থানে সামান্য কিছু ভুল্ভ্রান্তি হয়।অগত্যা 'বিদর্ভ নাট্য পত্র'-র সম্পাদকের অনুমত্যনুসারে লেখাটি 'অচেনা যাত্রী'-র উৎসব সংখ্যার রিভিউ বিভাগে পুনর্মুদ্রিত হল।লেখাটি কেমন লাগলো জানাবেন ।  

মন্তব্যসমূহ