নাট্য সমালোচনাঃ
ভাঙা ঘরের খেলা এবং 'ও'-কমপ্লেক্স
কুমারেশ পাত্র
কুমারেশ পাত্র
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ইয়ার্কি-ফাজলামি
যে বাঙালিরা আজও খুব একটা পছন্দ করেন না তার
সাম্প্রতিকতম নিদর্শন হল কিউ-এর 'তাসের দেশ'
। সিনেমা হোক বা থিয়েটার,রাবীন্দ্রিক
সেন্টিমেন্টকে সুন্দরভাবে পরিবেশন করার ক্ষমতা রাখেন এমন খুব কম ছিলেন বা আছেন বললেও
অত্যুক্তি করা হবে না বোধহয় ।
'গোবরডাঙা
নকসা'-র
আশিস দাস এই দ্বিতীয় পংক্তির-ই একজন ।
সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস
-এ
পরিবেশিত হল তাদের সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
'ঘরে
বাইরে'।এই
প্রযোজনা সত্যজিৎ -প্রভাব মুক্ত ,ষোলোয়ানা সাবেকি বাঙালিয়ানা ভাবাবেগে পরিবেশিত
এবং সমসাময়িক আন্তর্জাতিক অসহিষ্ণুতার পরিপ্রেক্ষিতে
প্রাসঙ্গিক ।এখানে 'ঘর' ও 'বাহিরের' মধ্যে আশিস দাস বাইরের জগৎ-এর
উপর বেশি জোর দিয়েছেন । তবে নাটকটিতে উপন্যাসের মূল সুরকে অত্যন্ত সুচারুভাবে ধরবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা করেছেন নাট্য-রূপকার
অরিন্দম সেনগুপ্ত ।তবে তিনি কিছুটা স্বাধীনতা গ্রহণ করতেই পারতেন
।অনুষঙ্গে কিছুটা সাহস ।কিন্তু
তিনি সে পথে হাঁটেননি ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
'নারী'
চরিত্রকে
মঞ্চে যথাযত ভাবে উপস্থাপন করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য
ব্যাপার ।পূর্বসূরীরা ঠারে ঠারে টের পেয়েছেন,আশিসও এর ব্যতিক্রম নন
।তবুও তিনি সে যুদ্ধে সফল ;আর তাঁর দিকে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন
বিমলার ভূমিকায় দ্বিপান্বিতা বণিক দাসের সুনিপুন অভিনয় ।
নাটকের
স্বার্থেই সন্দিপ এখানে 'মেকিয়াভেলিয়ান ভিলেন'
,আর মুরারী মুখোপাধ্যায় সে কাজে যথার্ত
। তাঁর ক্রূর চাউনি,কামুক
অভিব্যক্তি ও কন্ঠের মাদকতা এককথায় অনবদ্য ।
বৌঠানের
চরিত্রে প্রবীণ অভিনেত্রি নীলিমা সেনগুপ্তের মঞ্চে উপস্থিতি দর্শকদের মোহিত করে ।বিমলার
"খোঁপা
বাঁধা" প্রসঙ্গে তাঁর তীক্ষ্ণ শ্লেষ নাটকটির একটি
চমৎকার মুহূর্ত ।এ ছাড়া মাস্টারমশাই-এর
চরিত্রে অনিমেষ ভট্টাচার্য্য ও নিখিলেশের চরিত্রে অজিত সাহার অভিনয়ও বেশ ভালো ।ছোট
চরিত্রদের মধ্যে পাঁচুর ভূমিকায় অনিল মন্ডল ও অমূল্যের ভূমিকায় শুভঙ্কর দে-কেও
মনে রাখার মতো ।'Crowd' -এর
প্রতিটি দৃশ্যই সুনিপুনভাবে সম্পাদিত ;বিশেষ করে নৌকা ডুবিয়ে দেবার দৃশ্যটি চমৎকার
।
সঞ্চয়ন ঘোষের বুদ্ধিদীপ্ত মঞ্চপরিকল্পনা,বাদল
দাসের আলো ও স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহ নাটকটির ভাব ও ভাবনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক
।এ ছাড়া দেবাশিস দত্তর পোশাক ও পঞ্চানন মান্নার সাজ
উপন্যাসটির সাবেকিয়ানাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয় ।তবে
যোগ্য রাঁধুনির হাতে 'ঘরে বাইরে' সুস্বাদু হয়ে উঠলেও নাটকটির প্রথম পর্ব কিছুটা হলেও তত্ত্বভারে
ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে ।
সম্প্রতি নজরুল মঞ্চে পরিবেশিত হল 'কয়াডাঙা সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র'-এর
পরিচালনায় সোফোক্লেসের 'রাজা ওইদিপৌস ' ।
এরকম
বিশ্বমানের ক্লাসিককে মঞ্চস্থ করা যে সহজ কথা নয় তা যারা তাতে হাত দিয়েছেন কেবল তারাই
জানেন । অনেকেরই হাত পুড়েছে ।
কপালও
।এহেন প্রোডাকশানে হাত দেবার সাহস রাখার জন্য বিশেষ প্রশংসার দাবি
রাখেন তরুণ পরিচালক রাজেশ দেবনাথ ।তাঁর
'adaption' দারুণ ।রাজেশ এখানে
Brecht-এর
'theory' মেনে দর্শকদের বারংবার অবগত করতে লাগলেন যে তাঁরা সত্যিই এক সুদূর
অতীতের ঘটনা দেখছেন মাত্র ।
না, তাঁরা অতীতে হারিয়ে যান নি একদমই । অগত্যা
জিনস-টিশার্ট পরা এক আধুনিকা ডায়েরি হাতে অবতীর্ণ ন্যারেটরের ভূমিকায়
।সাবেকিয়ানায় পরিবেশিত নাটকটিতে ভেসে আসে সুদূর গ্রীসের ঘ্রাণ
।এখানে রানী ইওকাস্তার ভূমিকায় নবমিতা ঘোষ বেশ ভালো অভিনয় করেছেন
। তবে রাজার চরিত্রে রাজেশ দেবনাথ কিছুটা নিষ্প্রভ
,বিশেষ
করে তাঁর কন্ঠস্বর ওইদিপৌসের ব্যক্তিত্বের
সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি
।ক্রেয়নের ভূমিকায় সৌভিক ভট্টাচার্য্যও ভালো
।তবে ছোট চরিত্রগুলি বেশ ভালো ।প্রাজ্ঞের
ভূমিকায় উজ্জ্বল মন্ডল,তেইরেসিয়সের ভূমিকায় সুরজিত মজুমদার এবং মেষপালকের ভূমিকায় সাইমন
টুডু অসাধারণ । আর
এই নাটকের সব থেকে বড় প্রাপ্তি ছায়া [রাজা ওইদিপৌসের বিবেক
]-র
ভূমিকায় সুভজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ।তাঁর
কয়েক মুহূর্তের অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের বহুদিন মনে থাকবে ।
নাটকের
কোরাস অত্যন্ত নৈপুন্যের সাথে সম্পাদিত ও পরিবেশিত ।
এ
ছাড়া সুভিজিত গুহর আবহ ,রাজেশ দেবনাথের আলো এবং নীল কৌশিকের মঞ্চসজ্জা নাটকের
'tension' ও 'soul' -এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ
।তবে থিয়েটার হলটিতে শব্দ
নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে আরো বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল ।
মন্তব্যসমূহ